স্মৃতির আড়ালে রয়ে যাওয়া সুন্দর দিনগুলি
স্মৃতির আড়ালে রয়ে যাওয়া সুন্দর দিনগুলি
আজ আমার মনটা আনন্দে নাচছিল । আমি নদীতে স্নানে নেমেছি মাত্র । হাফপ্যান্ট টা নদীর পাড়ে ওপরে রেখে নদীর ওপরে একটি বাঁশের সেতু ছিল তার ওপর থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়া - এই হলো আমাদের স্নানের নমুনা । ভাবছি জলে আজ একটু লাফালাফি বেশি করেই করবো ।
না বেশি স্নান আর হলোনা । হঠাৎ বাবার গলার আওয়াজ। পাফপ্যান্ট টা এভাবে রেখেছিস যদি হারি রায় কি হবে । আমাকে বছরে একবার একটি হাফপ্যান্ট য়েই কিনে দিতো দাম ছিল ৫ টাকা । ডিসকু প্যান্টয়েই বেশি পছন্দ করতাম । আর একটি শ্যার্ট কিনে দিতো তা শুধু দূর্গাপূজা উপলক্ষেই । তাই আমি সবসময়ই প্যন্টটা যত্নকরেই রাখতাম কেননা আরেকটা যে আবার মায়ের পূজার সময়েই পাবো ।
বাবা ডাকদিয়ে বললো তাড়াতাড়ি বাড়ীতে আয় তোর জ্যামিনি পিসির সাথে নলবাড়ীতে যেতে হবে । শ্রীমন্ত মামার ( শ্রীমন্ত সরকার আমার বাবার মামা ) বাড়িতে মহোৎসব হবে তোর জ্যামিনি পিসিকে নিয়ে নলবাড়ীতে রেখে তারপর মহোৎসবে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসতে হবে । শুনে মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল - দুটি কারন এক আমার পরনের পায়ের চপ্পল ছিল না সেটা হয়তোবা পেয়ে যাব আর একয়দিন যেখানে যাবো নিশ্চই পেট ভরে খেতে পারবো ।
বাবা আমাকে ১২০ টাকা হাতে দিয়ে বলে দিয়েছে আমার জন্যে একজোড়া হাওয়াই চপ্পল গোরেশ্বর থেকে কিনে নিয়ে যেতে । আমি চপ্পল কিনে পিসিকে নিয়ে গোরেশ্বর থেকে রেলগাড়ি করে রঙিয়া পৌঁছেছি । রঙিয়া থেকে বাসে করে নলবারী শহরের গনেশ মন্দির পর্যন্ত গিয়ে নামতে হয়েছিল । গনেশ মন্দির থেকে ধমধমার বাসে করে বগরিতল নামের জাগায় নামতে হয় । তার পরে প্রায় ২ কিঃমিঃ হেঁটে হেঁটে নাহের বাড়ী গ্রামে পৌঁছেছি ।
নাহেরবাড়ী তে আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছে । তার মধ্যে শ্রীমন্ত সরকার ও তাদের পরিবারের সাথে সম্পর্কটাই সবচেয়ে বড় ছিল । তার প্রধানতঃ দুটি বিশেষ কারন ও রয়েছে । ১- শ্রীমন্ত সরকার আমাদের বৈশ্য কাপালী সমাজের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন ।২- তিনি তখন গৌহাটি শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যামন্দির উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন । তাড়াও শ্রীমন্ত সরকারের পিতৃ বংশের আত্মিয় স্বজন অনেক বড় ও আসাম রাজ্য ছাড়াও অন্য অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে ছিল।
শ্রীমন্ত সরকার ও আমার সাক্ষাৎ-১৯৯১
আমি শ্রীমন্ত সরকার এবং ওনার পরিবারের সবারি সাক্ষাৎ লাভ করি ১৯৯১ সনে । আমি তখন সপ্তম শ্রেণী উক্তীর্ন হয়ে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। শ্রীমন্ত সরকারের বাবার ভাগ্নি হলো আমার বাবার মা অর্থাৎ আমার ঠাকুমার মামা হলেন শ্রীমন্ত সরকারের বাবা । সেইসম্পর্কে শ্রীমন্ত সরকার আমার বাবার মামা আর আমার দাদু । আমি ছোটবেলা থেকেই দাদুর কথা শুনে এসেছি । আমার বাবার চাকরি ও অন্যান্য কিছু নথিপত্রের সমস্যা সমাধানের পরামর্শের জন্য শ্রীমন্ত সরকার দাদুর কাছেই ছুটে যেতো । আমার বাবার মত প্রচুর আত্মীয়ের ভির সব সময় শ্রীমন্ত দাদুর বাড়ীতে লেগেই থাকতো । সবারি আশ্রয়ের শেষ জায়গাটাই ছিল শ্রীমন্ত সরকার। আমরা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সাধারন মানুষ ,তাই শহরের মানুষের প্রতি এমনিতেই একটা কৌতুহল ছিল আগে থেকেই তার পর এতবড় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং একজন স্বনামধন্য প্রিন্চিপাল কি ভাবে কথা বলবো কোথা থেকে শুরু করবো কিয়েই বা বলবো আমি শহরের ভাষাও বলতে পারিনা এইসব ভাবতে ভাবতেই নাহের বাড়ীতে পৌঁছে গেছি । ১৯৯১ সালে নাহের বাড়ীতে শ্রীমন্ত দাদুর বাবার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মহাপ্রভূর ভোগ নিবেদন করে ১৬ প্রহরের মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমার নাহের বাড়ীতে আসার উপলক্ষ এটাই ছিল। নাহের বাড়ীতে পৌঁছার পরে অবিনাশ সরকারের বাড়িতেই প্রথম উঠেছি একটাই উঠুন ছিল ,তিনি শ্রীমন্ত দাদুর ভাই হয় তাছাড়া অবিনাশ দাদুর ছেলে মিন্টু সরকার আমাদের খয়রাবাড়ীর ঝালুকবাড়ীর বাড়ীতে এসেছিল তাই মিন্টু কাকুকে পেয়ে মনটা অনেকখানি সহজ হয়ে গিয়েছিল। মিন্টু কাকুই শ্রীমন্ত সরকার, ওনার স্রী ও অন্যান্য সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । আমি শ্রীমন্ত দাদুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম,দাদু আমাকে দেখে হেসে হেঁসে সবার কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে বলছিলেন আমি নাকি অনেক লম্বা হয়ে গেছি আর মহোৎসব শেষ হওয়ার পরেও কিছু দিন থাকতে বলছিলেন
মহোৎসবের সময়ে বাড়ীতে প্রচুর কাঁদা হয়েছিল , বৃষ্টি ছিল ,গ্রামের বাড়িতে সব দিকেই কাঁচা মাটি তাই পায়ে কাঁদা মাটি নিয়েই সবাই কীর্তন করেছিল আমিও করেছিলাম । শ্রীমন্ত দাদুর আরো ৩ ভাই ছিল ১-? ২ -হেমন্ত ও ৩ - সুশান্ত
মহোৎসবের পরে শ্রীমন্ত দাদুর দুই মেয়ে আমার পিসি ও ঠাকুমা ওনাদের সাথে গৌহাটি মেতে বলায় আমি ও রাজি হয়ে গেলাম । বগরিতল তলায় ডাইরেক্ট গুয়াহাটির বাসে উঠে চলে গেছি । আমরা অনেক কয়জন ছিলাম বাসের ভাড়া বড় পিসি তৃপ্তি সরকার দিয়েছিল মনে পড়ে । ৪/৫ দিনের মত ছিলাম । শ্রীমন্ত দাদুর খারুপেটিয়ার ছোট ভাইয়ের ছেলে শুকু কাকু তখন ওখানে থেকেই পড়াশোনা করতো । শুকু কাকু ,দ্বীপ কাকু আমি আরো কয়েকজন ছিল আমরা মালিগাও থেকে হেঁটে হেঁটে মা কামাখ্যা মন্দির দর্শন করতে গিয়েছিলাম । গৌহাটি চিরিয়াখানাতে গেছি হলে সিনেমা দেখেছি । বেশ আরামেই দিনগুলো কেটেছিল । সকালে উঠেই চা খাওয়া ,৯/১০ পেট ভরে ভাত খাওয়া , দুপুর ২/৩ টায় আবার ভাত খাওয়া তার পরে একটু বিশ্রাম করা । বিকালে উঠে আবার টিফিন খাওয়া তার পরে টিভি দেখা । রাত ৯/১০ টায় ভাত খেয়ে শুয়ে পড়া । রান্না ঘরটায় সব সময় রান্না চলতেই থাকতো আর লোকজন আসতেই থাকতো খাওয়া চলতেই থাকতো । এত জানা অজানা লোকের সমাগম আর বিরাগ বিহীন সেবা আপ্যায়ন বড় বিরল । শ্রীমন্ত সরকার দাদুর এবং ওনার সহধর্মিনী আমার ঠাকুমার এই নিস্কাম সেবা ওনাদেরকে মহান করে রেখেছিল । একটি অভিজাত পরিবার , উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সমাজের প্রতিষ্টিত বিগ্যজন হয়েও আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষকেও স্নেহ মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে ভরে দিয়েছিল । তার পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে মানেই গৌহাটি আসতাম দাদুর কাছে আসতাম । শ্রীমন্ত দাদুর অনুপ্রেরনাতেই হৌজাই গীতাশ্রমে আর এত এত এর ওটিচি করতে ওনার সাথে গিয়েছিলাম।
শ্রীমন্ত সরকারের সান্যিধ্যে -১৯৯৭
আমি ১৯৯৭ সনে দরঙ কলেজ তেজপুর থেকে বি এ পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিগ্যান বিভাগে এম পড়তে এসে দাদুর কাছে এসেছি । দাদু তখন অবসর গ্রহণ করেছেন ,পেনশন টা রেগুলার হয়নি তাদেরকে সারা জীবন উপকার করেছিলেন তাদের মধ্যে ২/১ জন দাদুকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলেন, তেতেলিয়াতে ওনার বাড়ীর পাশে মতিলাল বিশ্বশর্মার বাড়ীতে আমি থাকতাম আর দাদু কয়েকটা টিউশন যোগার করে দিয়েছিলো সেগুলো করে পড়াশোনা করতাম । সকাল ৫ টার সময় হাঁটতে হাঁটতে এসে আমাকে ডাকতো সুধেন্দুমোহন ঘুমকে তাড়াও উঠো উঠো উঠো । অনেক কাজ আছে জীবনে । আমি ও ঘুমের নিশায় কোনো দিন উঠে যেতাম আর কোনদিন বইটা নিয়ে দাদুকে ভয়ে মিথ্যা বলতাম আমি উঠে গেছি বই পড়ছিলাম।
তার পরে সকালে ৬/৭ টায় দাদুর বাড়ীতে বাথরুম করে প্রধান করে বসতাম ,ঠাকুমা বলতো চা খেয়ে যেও ,চা খেয়ে একটু টিভি দেখতাম ,নিউজ পেপার পড়তে পড়তেই আবার ঠাকুমা বলে উঠলো রাতের তরকারি টা অনেকটাই রয়ে গেছে ভাত খেয়ে যেও । ৯ টায় আবার গরম ভাত । তার পরে আমি ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসে বা অন্য কোনো কাজে চলে যেতাম । সন্দ্বার পরে টিউশন শেষ করে আবার দাদুর বাড়ীতে যাওয়ার পরে কিছু খাবার দিতো । পিঠা,পায়েস বা অন্য কিছু না কিছু একটা । তার পরে টিভি টা দেখতে দেখতে আবার ঠাকুমা বলে উঠতো এই যে চাউল দিয়া ফালাইছি না কইয়া যাতে যাওয়া না হয় । এই করতে করতে ৯-৩০/১০ টায় ভাত খেয়ে তার পরে আমার রুমে যাওয়া ।
দাদুর সাথে আলোচনার বিষয় বস্তুর বেশিটাই ছিল রাষ্ট্র সেবা, জন্মভূমি পূর্ব বাংলা ত্যাগ এবং বাঙালি হিন্দুদের ভবিষ্যত । সম্পর্কে দাদু নাতিন তাই আমাদের আলোচনায় কোনো রেষ্টিকশন ছিলনা আমি ও সব কথা জানার আগ্রহ করতাম আর তিনিও আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করতেন ।
আমি শ্রীমন্ত সরকারর মধ্যে একজন সত্যিকারের রাষ্ট্র ভক্তি থাকা ব্যক্তিত্ব দেখেছি । দেশ বিভাজন ও মাতৃভূমির ত্যাগ এই আঘাতটা ওনার জীবনে সর্বক্ষণ ব্যথিত করে রেখেছে । হিন্দুদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি এখনো শন্কিত । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ওনার অফুরন্ত ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা গ্রন্থকেই মানুষের জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল বলে মনে করেন।
আমি শ্রীমন্ত সরকার দাদুর সুস্থ স্বস্ত এবং সুন্দর জীবন সর্বক্ষণ পরম ঈশ্বরের শ্রীচরণে প্রার্থনা করি ।
সুধেন্দু মোহন তালুকদার
মঙলদৈ
Comments
Post a Comment